Wednesday, February 26, 2014

বইমেলা ও লেখক হওয়ার সহজ উপায়

বইমেলা ও লেখক হওয়ার সহজ উপায়
- রূপ অরূপ-সাজজাদ হোসাইন খান

বইমেলার উত্তাপ আর মাত্র দু-একদিন। তারপর ভাঙবে মিলনমেলা। খাঁ খাঁ করবে বাঙলা একাডেমীর প্রাঙ্গণ। এরপর আগামী মেলার অপেক্ষা। এবারও উৎসাহ ছিল, উচ্ছবাস ছিল, বই প্রকাশের আনন্দ ছিল। একুশের বইমেলা বা ফেব্রুয়ারি মাস এখন বই প্রকাশের মাস। এ মাসে প্রকাশকদের যেমন ব্যস্ততা বেড়ে যায় পাশাপাশি লেখকরাও ব্যস্ত থাকেন যে করেই হোক মেলায় নিজকে উপস্থাপনের আশায়। প্রতিবারের মত এবারও নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে বিপুল। পত্রিকায় এসেছে প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা নাকি প্রায় আড়াই হাজারের মত। যেখানে সারা বছরে আড়াইশ বই প্রকাশ পায় কিনা সন্দেহ সেখানে এত বিপুল সংখ্যার বই বাজারে আসা সত্যিই প্রকাশকদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। মেলায় ব্যবসাটাও মন্দ হয় না। নেতিবাচক দিক হলো নতুন প্রকাশিত বইগুলোর অধিকাংশেরই মান, বিষয় এবং সাহিত্যিক মূল্য ভিষণভাবে নিম্ন এবং অপাঠ। ইতোমধ্যে মুখ খেলেছেন অনেকেই। পত্রিকায়ও এসব মতামত ছাপা হয়েছে। নতুন প্রকাশিত এত বিপুল সংখ্যার বই থেকে যদি আড়াইশ বইও আলাদা করা যেত যেগুলোতে সৃজনী প্রতিভার স্বাক্ষর আছে, মেধা এবং জ্ঞানের ঔজ্জ্বল্য আছে তাহলেও হয়তো মনকে প্রবোধ দেয়া যেত। তুল্য মূল্যে দেখা যাবে আঙ্গুলে গোনা আট-দশখানা বাদে আর সব সস্তা চিন্তার স্বপ্নপুরী। যে স্বপ্ন এককাপ চা পান করতে করতেই ফুরিয়ে যায়। ইদানীং আমাদের অনেক নামিদামি লেখকও পরিশ্রম করতে নারাজ। যে কারণে এত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও আমাদের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই। না সাহিত্যে, না ইতিহাসে না, জ্ঞান বিজ্ঞানে। যা কিনা জাতিকে দিশা দেবে। একটি চিন্তাশীল উপন্যাসও জাতির মুক্তির পথকে প্রশস্ত করতে সক্ষম।

আজকাল লেখক হওয়াটা কোন বিষয়ই নয়। অধ্যবসায়ের কোন প্রয়োজন নেই, পড়াশোনার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই চিন্তা-ভাবনার। লেখক হবার মূলশক্তি এখন অর্থবিত্ত। আমলার বউ, মন্ত্রীর ড্রাইভার আর এমপির মেয়েরা এখন লেখকের তালিকার শীর্ষে। এসব মৌসুমী লেখকদের জন্য প্রস্তুত থাকে মৌসুমী প্রকাশকরা। মেলার আগেভাগে জন্ম নেয়া ‘ওয়ান টাইম' প্রকাশকগণ কৈয়ের তেলে কৈ ভাজেন। সে ভাজা সুস্বাদ হলো না বিস্বাদ হলো তা দেখার সময় তাদের থাকে না। এসব দেখার প্রয়োজনও তারা বোধ করে না। তাদের নজর অর্থের দিকে। আর লেখকের আগ্রহ বই প্রকাশের দিকে। লেখাটি প্রকাশযোগ্য কিনা মৌসুমী প্রকাশকরা যেমন ভাবে না মৌসুমী লেখকরা তো মনে করেন তার সৃষ্টি বিশ্বমানের। যদিও এসব বইয়ের অধিকাংশই অখাদ্য-কুখাদ্য। এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয় তাহলে তো প্রকাশনার জগত জঙ্গলে পূর্ণ হবে। এরিমধ্যে যা প্রকাশ পেয়েছে তার অধিকাংশই জঞ্জাল। এসব অখাদ্য-কুখাদ্য ছাপতে গিয়ে ধ্বংস হচ্ছে কাগজ-কালি। কাগজের দাম বাড়ছে ছাপার মূল্যও বেড়ে যায় শনৈ শনৈ। মূল্য বৃদ্ধি পায় বইয়ের, প্রকৃত প্রকাশকরা পড়েন বিপদে। পাঠক-ক্রেতারও গুনতে হয় বেশি অর্থ। তাই বই প্রকাশেরও একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। ন্যূনতম মান বজায় রেখে বই প্রকাশ করা উচিত। মৌসুমী লেখকদেরও উচিত লেখা শুরুর আগেই বই প্রকাশের চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা। অবশ্য এজন্যে দায়ী মৌসুমী প্রকাশকরা। তাদের উৎসাহেই অনেকে বই প্রকাশে আগ্রহী হয়ে উঠেন। অনেক সৃষ্টিশীল প্রতিভা নিজেদের ভাবনা-বিবেচনা উপস্থাপন করতে পারেন না; অর্থের অভাব, প্রতিপত্তির অভাব। প্রকাশকরাও তাদের খোঁজ রাখে না। সংগীতের জগতেও একই ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে এখন আর সাধনার দরকার নেই, গলার দরকার নেই। টাকা থাকলে গায়ক হওয়া যায়, গীতিকার হওয়া যায়। গানের ক্যাসেট বাজারে আসছে শতশত। বড় বড় পোস্টার-বিজ্ঞাপন। সংগীতের জগতেও বইয়ের জগতের মতই মানসম্পন্ন গলা এবং গানের অভাব প্রকট। কেবল লম্ফঝম্ফই সার। নকলের ভিড়ে আসল এখন নির্জীব। এবারের বইমেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। 
বই তো শুধু আনন্দের জন্যেই পাঠ করে না, জ্ঞান আহরণের প্রয়োজনেও পাঠ করে। বই নীতিবোধ শিখায়, সভ্যতা শিখায়, দেশের প্রতি মমত্ববোধ শিখায়, জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে সাহায্য করে। বইমেলায় এই রকম বই কতটা প্রকাশ পেয়েছে বা পায়? বইমেলায় প্রচুর বই বিক্রি হয়, এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। বেশি বিক্রির অর্থ এ নয় যে, লেখার মান উন্নত হয়েছে। মেধাসম্পন্ন বই জ্ঞানের বই বা গল্প উপন্যাস কবিতার বইও হতে পারে। ইতিহাসের বই হতে পারে ধর্ম আশ্রয়ী বই হতে পারে। প্রকাশকদের মত হল এ জাতীয় বইয়ের কাটতি কম। লেখক এবং প্রকাশক পাঠকের রুচিবোধকে বদলে দিতে পারেন। ভাল বই লিখলে এবং প্রকাশ করলে ভাল পাঠাকেরও অভাব হবে না বোধ হয়। মেধাশূন্য বই বাজারে এনে পাঠকের রুচিবোধকে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রকারান্তরে। মেলার আয়োজকগণ এই দিকটির প্রতি তীক্ষ্ণ নজর দিলে একটা গতি হতে পারে হয়তো। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, দেশের ভবিষ্যৎ। তাই পঠন পাঠ তাদেরকে সেভাবেই তুলে আনা প্রয়োজন। কিন্তু তাদের হাতে ভূত আর পেত্নীর বই তুলে দিচ্ছি। এবারের মেলায়ও ভূত-পেত্নী আর আজগবি গালগল্পের বইয়ে সয়লাব। অভিভাবকরাও সন্তানদের হাতে উঠিয়ে দিচ্ছেন এসব বই। শিশুরা এগুলো থেকে কিছুই শিখতে পারছে না। শিশুরা যাতে করে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠতে পারে, দেশপ্রেম জাগরিত হয়, পাঠযোগ্য এমন বই কই? গল্প, কাহিনীর পাশাপাশি সহজ ভাষায় বড় বড় মনীষীর জীবনী পাঠে শিশুদের আগ্রহী করে তোলা দরকার। এমন প্রয়াসের কোন লক্ষণ তো দেখা যায় না কোন মেলাতেই। অভিভাবকরা এ ব্যাপারে সক্রিয় হতে পারেন। শিশুদের পাঠের রুচিতে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারে প্রকাশকরা, লেখকরা। প্রকৃত শিশু-সাহিত্য বলতে যা বুঝায় দেশে এমন সাহিত্য অপ্রতুল। প্রকাশে পরিপাট্য থাকতে পারে কিন্তু সাথে মেধা এবং সৃষ্টিশীলতা না থাকলে শুধু চাকচিক্যে তেমন উপকারে আসে না। তাই পরিকল্পনামাফিক শিশুসাহিত্য সৃষ্টিতে অগ্রসর হতে হয়। পরিকল্পনার অভাব এবং সচেতনতার অভাব সাহিত্যের এই অংশটি এখনো নিষ্ফলা প্রায়। তাই শিশুদের মেধার ঘরটি এখন ভূত-পেত্নীর বৈঠকখানা। এই ধারা প্রবল হলে সর্বনাশের সমূহসম্ভাবনা।
বইমেলা আগামীতেও আসবে। তাই এখন থেকেই প্রকাশকদের মনস্থির করা উচিত মানসম্পন্ন বইয়ের বাইরে আর কোন প্রকাশনা নয়। উন্নত দেশগুলোতে সব বড় প্রকাশকেরই সম্পাদনা বোর্ড থাকে। ভালো সম্পাদনার পরই পান্ডুলিপি তারা প্রকাশ করে। এদেশেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কারো এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই। যে জন্যে অখাদ্য-কুখাদ্য এত সহজে বাজারে চলে আসে। এমনটা কোনভাবেই হওয়া প্রত্যাশিত নয়।  
                  

No comments:

Post a Comment