Wednesday, January 15, 2014

সৃজনশীল সাহিত্যগ্রন্থ প্রকাশে সমস্যা

- মাহফুজ সিদ্দিকী



মহান একুশে বইমেলা আসছে। সৃজনশীল গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা , ছড়া ও অনুবাদ গ্রন্থের মেলা বসবে। কিন্তু যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা ও সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশ বুঝি বন্ধই হয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থ যেমন গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও অনুবাদ গ্রন্থ ইত্যাদির প্রতি সরকারের কোনো দরদ নেই; এসবের কোনো প্রয়োজন সরকার মনে করে না। কারণ সরকার ব্যস্ত শুধু পাঠ্যপুস্তক নিয়ে। সরকার সম্ভবত জানেই না যে, সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশে বিরাট বাধার সৃষ্টি হয়েছে। যে বাধা অতিক্রম করা সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।
আগে নিয়ম ছিল, ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং নিজ খরচায় যে কেউ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারবে। যেকোনো বাইন্ডিংখানায় বই বাইন্ডিং করাতে পারবে; যে কোনো লাইব্রেরিতে বইয়ের কপি দিতে পারবে বিক্রির জন্য। এখন সে নিয়ম মোটেই নেই। এখন যদি কেউ গল্প, উপন্যাস, নাটক বা কবিতার বই প্রকাশ করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই কোনো না কোনো রেজিস্টার্টড পাবলিশারের মাধ্যমে করতে হবে। ওই পাবলিশার যাকে দিয়ে ইচ্ছা বই বাইন্ডিং করাবে এবং যেভাবে খুশি বই বিক্রির ব্যবস্থা করবে। এখন শুধু তা-ই নয়, ওই পাবলিশারের অনুমতি ছাড়া কোনো বাইন্ডার বই বাইন্ডিং করবে না। কোনো লাইব্রেরিতে বই দেওয়া যাবে না বিক্রির জন্য। কোনো লাইব্রেরি নেবেও না বইটি। 
আগে রয়্যালটি প্রথা ছিল অর্থাৎ কারো বই পাবলিশার তার নিজের খরচে প্রকাশ করত। পা-ুলিপির বিনিময়ে কিছু অর্থ নগদ দিয়ে দিত; বাকি টাকা বই বিক্রি হওয়ার পরে দিত। এখন সে প্রথা নেই। এখন পাবলিশারকে গ্রন্থ প্রকাশের জন্য সব টাকা অগ্রিম প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে হয়। লেখকের কোনো পরামর্শ বা কোনো অনুরোধের ধার পাবলিশার ধারে না। 
আগে একটি সৃজনশীল গ্রন্থ (১০ ফর্মা অর্থাৎ ১৬০ পৃষ্ঠা ) কর্ণফুলি সাদা কাগজে প্রকাশ করতে খরচ পড়ত ৫-৬ হাজার টাকা। স্বাধীনতার পর ৮০ দশকেও পড়ত ১৫-২০ হাজার টাকা। এখন ১৬০ পৃষ্ঠার একটি বই সাদা অফসেট কাগজে (কর্ণফুলি সাদা কাগজে বই ছাপা উঠে গেছে, সেখানে অফসেট কাগজ ব্যবহারের প্রচলন হয়েছে) ছাপতে খরচ পড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো। একটি বইয়ের দাম ধার্য হয় সর্ব নিম্ন ২০০ টাকা। 
আগে সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশে সরকারের সুদৃষ্টি ছিল, সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাও ছিল। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর পর্যন্তও সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশনার ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেখা গেছে। তখন এ ধরনের বই ছাপার কাগজের জন্য আবেদন করলে সরকার কম মূল্যে অর্থাৎ মিল রেটে কাগজ সরবরাহ করত। তাতে বাজার দরের তুলনায় অনেক কম দাম পড়ত কাগজের। ৭৪-৭৫ সালে আমার প্রথম গল্প গ্রন্থ 'প্রেম তুই সর্বনাশী' গ্রন্থ প্রকাশের ইচ্ছা করলে আমার আবেদনক্রমে সরকার আমাকে ১৯ রিম কর্ণফুলী সাদা কাগজ মিল রেটে সরবরাহ করেছিল। তাতে গ্রন্থ প্রকাশের খরচে আমার অনেক টাকার সাশ্রয় হয়েছিল। এখন সরকারের পক্ষ থেকে লেখকদের সে রকমভাবে কাগজ দেওয়ার সিস্টেম নেই। এখন কাগজ দেওয়া হয় না, সরকারি কোনো আর্থিক সাহায্যও লেখককে দেওয়া হয় না। এমনকি সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর সরকার রাখা দরকার মনে করে না। 
পাকিস্তান আমলে সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থ প্রকাশে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। তখন বিএনআর-এ পান্ডুলিপি জমা দেওয়ার নিয়ম ছিল। পান্ডুলিপি মানসম্মত হলে বই তো ছাপা হতই, উপরন্তু পা-ুলিপির বিনিময়ে লেখককে নগদ অর্থ প্রদান করা হতো। বিএন আর-এর অফিস ছিল কার্জন হলের পূবে, ওসমানি উদ্যানের পশ্চিমে। লাল বিল্ডিংটিতে পরবর্তীকালে মন্ত্রী ফনিভূষণ থাকতেন। ওই বিএনআর-এ পা-ুলিপি জমা দিয়ে (১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে) আমি নগদ তখনকার দিনে আট হাজার টাকা পেয়েছিলাম। বিএনআর আমার বইও প্রকাশ করেছিল। এখন আর এ রকম সরকারি সহযোগিতার প্রথা নেই। 
সরকার শিক্ষার হার বাড়াতে চাচ্ছে। জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থ ছাড়া যে উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে যাবে সেটা হয়তো সরকার উপলব্ধি করতে পারছে না। এটা সরকারের অদূরদর্শিতা। যার ফলাফল আখেরে ইতিবাচক হবে না। এক সময়ে সৃজনশীল সাহিত্য চর্চা বন্ধ হয়ে যাবে; জাতি নিমজ্জিত হবে অন্ধকারে। কাজেই এ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে সৃজনশীল সাহিত্য চর্চায় এবং সৃজনশীল গ্রন্থ রচনায় সরকারকে এগিয়ে আসতেই হবে। অর্থ, কারিগরি সব রকম সাহায্য সহযোগিতা সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে। না হলে জাতির ইতিহাস কে লিখবে, সে ইতিহাস গ্রন্থ কিভাবে প্রকাশ পাবে সে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
আগে সরকার লেখককে বাঁচিয়ে রাখতে, লেখকের কলমকে চালু রাখতে, লেখকের চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতাকে লালন করতে লেখকের বই কিনে নিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পাবলিক লাইব্রেরি এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সরকার বই কিনত। তাতে একজন লেখকের খুব একটা লোকসান হতো না। এখন সে নিয়ম উঠেই গেছে বলা চলে। শুধু মাত্র জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র মারফত কিছু বই কেনা হয় তাও পাবলিশারের কাছ থেকে। একজন লেখকের মাত্র ৫ কপি এবং একজন পাবলিশারের কাছ থেকে সর্বমোট ২৫ কপি নেওয়া হয়। কোনো লেখকের কাছ থেকে কোনো বই নেয়া হয় না। কারণ বই জমা দিতে একটি ফরম পূরণ করতে হয়। সে ফর্মে ট্রেড লাইসেন্স এবং ইনকামট্যাক্স প্রদানের পরিমাণ উল্লেখ করতে হয়; তাছাড়া বই প্রকাশের বহুদিনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে হয়; যা একজন লেখকের থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। কাজেই ধরে নেয়া যায় সৃজনশীল সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত কোনো লেখক তার গল্প গ্রন্থ, উপন্যাস, নাটক বা কবিতার জন্য সরকারের কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে না। আর এ না পাওয়া জাতির জন্য সমূহ ক্ষতির কারণ। 
সরকার পাঠ্য পুস্তক ছাপার জন্য ছাপা,কাগজ, বাইন্ডিংসহ যাবতীয় খরচ দিয়ে থাকে। অথচ সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থের বেলায় সরকারের হাতের মুঠ খুলছে না; এ রহস্য আমাদের বোধগম্য নয়। এখনো আমরা বলব, জাতিকে শিক্ষিত উন্নত ও সমৃদ্ধ করে তুলতে সরকারকে সৃজনশীল সাহিত্য গ্রন্থের দিকে নজর দিতেই হবে; এর কোনো বিকল্প নেই। সরকারের কত অর্থ কত ভাবে ব্যয় হচ্ছে। কত অর্থ নষ্টও হচ্ছে। সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ থেকে কিছু পরিমাণ সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ধার্য্য রাখলে নিশ্চয়ই তাতে সুফল আসবে। অর্থও সদর্থে ব্যয় করা হবে। আমরা আশা করব, সরকার বিষয়টিকে সহৃদয় বিবেচনায় নেবে এবং সৃজনশীল সাহিত্য চর্চাকে বাঁচিয়ে রাখায় সচেষ্ট হবে। 
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আসছে, আসছে একুশে বইমেলা। এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর সময় এখনই।


Tuesday, January 7, 2014

জনপ্রিয় লেখক তৈরীতে আমাদের করণীয়

জনপ্রিয় লেখক তৈরীতে আমাদের করণীয়

শামীম রেজা

আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের বিখ্যাত দু’জন লেখকের নাম বলেন, আপনার মাথায় প্রথম যে দু’জন লেখকের নাম ভেসে উঠবে তারা হচ্ছেন হুমায়ূন আহম্মদ এবং জাফর ইকবাল। একটা সময় বাংলাদেশের বইয়ের দোকান গুলো ছিলো ভারতীয় লেখকদের দখলে। সম্ভবত শুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ এতই সাহিত্যপ্রেমী সেখানে বাস,ট্রেন,লঞ্চে গল্প-উপন্যাসের বই বিক্রি হয়। অথচ এই বাংলাদেশের মানুষই জিম্মি হয়েছিলো পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুঘেষা এবং ধর্মবিদ্বেষী লেখকদের কাছে।

বাংলাদেশের মানুষকে এই পশ্চিম বঙ্গীয় সাহিত্য থেকে টেনে এনে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সাহিত্যের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়ার একচেটিয়া কৃতিত্ব অবশ্যই হুমায়ূন আহম্মদের প্রাপ্য। তার পথচলায় অনুপ্রাণীত হয়ে আরো অনেক কথাসাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে এদেশে। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন হুমায়ূন আহাম্মদ নাস্তিক ছিলেন, হয়তো তাদের অভিযোগ সত্য অথবা মিথ্যা কিন্তু সেটা মূখ্য বিষয় নয়। হুমায়ূণ আহাম্মেদ সাহিত্য রচনা করেছিলেন এদেশের প্রেক্ষাপটে, মুসলিম পারিবারিক জীবন ছিলো তার লেখার উপজীব্য, এদেশের পাঠকের মনমানসিকতার দিকেও তিনি ছিলেন সজাগ দৃস্টির অধিকারী। তিনি তার সাহিত্যে ঢালাও ভাবে নাস্তিকতার প্রচার করেননি, যেটা করেছেন ভারতীয় লেখকরা। সেদিক থেকে হলেও, নাই মামার চেয়ে কানা মামা নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি।

আলহামদুলিল্লাহ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর পর্যাপ্ত বই রয়েছে, যেসব বইয়ের ঘাটতি আছে সেগুলো অনুবাদ করা হয়েছে। অভাব যেটা সেটা হচ্ছে মানসম্পন্ন ইসলামীক ভাবধারার গল্প-উপন্যাসের। এখন যদি আমি প্রশ্ন করি, ইসলামীক গল্প-উপন্যাস লিখবেন এমন ভালোমানের সাহিত্যিক এদেশের সৃস্টি হচ্ছেনা কেনো? তাহলেই অনেকে রেডিমেইড উত্তর দিবেন, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। অথবা অন্য আরেকজন হয়তো জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলবেন ওই সব ডানপন্থী-বামপন্থী দেখে সাহিত্যিক সৃস্ট হয়না, সাহিত্য রচনা হচ্ছে জন্মগত প্রতিভা। যারা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের কথা উল্লেখ করবেন তাদের যুক্তি হয়তো এমন হতে পারে, 'অন্য প্রকাশে'র মতো খ্যাতিমান প্রকাশনী সংস্থা আমাদের নাই। অথবা ভালোমানের পরিবেশক প্রতিষ্ঠানও আমাদের নেই।

আমরা ডানপন্থী অঙ্গনে জনপ্রিয় উপন্যাস 'সাইমুম সিরিজে'র কথা উল্লেখ করতে পারি, কিন্তু জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে সেটা হুমায়ূন আহম্মদের 'মিসির আলী'র ধারের কাছেও নেই, এর কারণ কি? এটাকি শুধুমাত্র ভালোমানের পরিবেষক এবং প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানের অভাবের কারণে! আসলে যুক্তিটা কতটুকু ধোপে টিকবে? আমরা সবাই সিএইচপি বা স্পন্দন অডিও ভিজ্যুয়াল সেন্টারের নাম জানি, তাদের ক্যাসেট বাংলাদেশের কয়টা দোকানে পাওয়া যায়? শতকরা হিসেব করলে বলা যায় অতি নগন্য। অথচ এই সিএইচপি যখন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মাহফিলের ক্যাসেট বাজারজাত করে তখন মানুষ লাইন করে সেই ক্যাসেট কিনে নিয়ে যায়। তার মানে বিষয় পরিস্কার, ‘অন্য প্রকাশ’ হুমায়ূন আহম্মদকে জনপ্রিয় করেনাই, বরং হুমায়ূন আহম্মদই ‘অন্যপ্রকাশ’কে জনপ্রিয়তার শিখড়ে নিয়ে গেছে। একজন পাঠক যখন বইয়ের দোকানে গিয়ে বলে আবুল আসাদের সাইমুম সিরিজ আছে? তখন দোকানদার তার দোকানে সাইমুম রাখতে বাধ্য হয়, এটাই নিয়ম।

ঘুরে ফিরে আবার একই প্রশ্ন এসে হানা দেয় তাহলে আমাদের দূর্বলতা কোথায়? আমাদের সাহিত্যকর্ম, যেমন সাইমুম সিরিজ এবং অনুবাদ সাহিত্য ক্রুসেড সিরিজ জনপ্রিয়তা পাচ্ছেনা কেনো? এখানে আমি দু’টি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসবো, একটা হচ্ছে আমরা পাঠক মন বুঝে সাহিত্য রচনা করিনা দুই হচ্ছে আমাদের মধ্যে লেখনি শক্তির অভাব।

হুমায়ূন আহম্মদকে আমরা নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করি, ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ূন আহম্মদের বিশ্বাস যাই হোকনা কেনো, একজন পাঠক অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সার্চ না করলে তার লেখায় নাস্তিকতা খুজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার, কারণ তিনি মুসলিম পাঠকদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন, উল্টাপাল্টা কিছু লিখলে পাঠক হারাতে হবে সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন। 
অন্যদিকে আমরা যদি জাফর ইকবালের সাহিত্যের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো অনেকটা প্রকাশ্যেই তিনি তার উপন্যাসে নাস্তিকতার প্রচার করছেন, তারপরেও তার লেখার জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে তিনি পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন। পাঠক সায়েন্স ফিকশন পড়তে চাচ্ছে, বাংলাতে বিকল্প ভালো মানের সায়েন্স ফিকশন না থাকাতে বাধ্য হয়ে একটু কনসিডার করে হলেও পাঠক তার সাহিত্যই গিলছে। 

এবার আসি আমাদের মানসম্পন্ন লেখকের অভাব প্রসঙ্গে, অতীতের কথা বাদ দিলেও এখন যদি আমরা অনলাইন জগতে ভালোমানের লেখকদের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে তাদের ৭৫% হচ্ছেন বাম ভাবধারার লেখক। এর কারণ কি? লেখকরা কি জন্ম থেকেই বাম হয়ে জন্মগ্রহণ করে? মূল সমস্যা হচ্ছে বাম অঙ্গনে সাহিত্যের যতটুকু চর্চা হয় তার তুলনায় আমাদের অঙ্গন ফাঁকা! আমরা সাহিত্য চর্চা করিনা এটাই হচ্ছে আসল কথা, যাও করি ব্যক্তিগত উদ্যগে দুই’চার লাইন লিখে একদিন হাওয়া। ফলশ্রুতিতে লেখা-লেখি যাদের রক্তে মিশে আছে এমন নিরপেক্ষ মনমানসিকতার তরুণ প্রজন্ম সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে, বামদের সংষ্পর্ষে নিজের অজান্তেই একজন চরমপন্থী বাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

লেখার মূল টপিক ছিলো, জনপ্রিয় লেখক তৈরীতে আমাদের করণীয়। উপরের আলোচনাতেই মূল বিষয়গুলো চলে এসেছে। নিজস্ব প্লাটফর্মে সাহিত্যচর্চার পরিবেশ সৃস্টি, উদীয়মান লেখকদের একই প্লাটফর্মে যুক্ত করা, সর্বোপরী প্রকাশনা সহ সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করা। একটা কথা আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, মায়ের গর্ভ থেকে কেউ উপন্যাসিক হয়ে জন্ম নেয়না, লিখতে লিখতেই লেখক। হয়তো আমাদের মধ্য হতেই বেরিয়ে আসবে যুগশ্রেষ্ঠ কোনো সাহিত্যিক, স্বপ্ন দেখতেতো পাপ নেই!

Source: Shamim Reja




Tuesday, November 12, 2013

বই বাজারের চিত্র : অতিদামের চাপে কমে যাচ্ছে পাঠক

বই বাজারের চিত্র : অতিদামের চাপে কমে যাচ্ছে পাঠক

- সদানন্দ সরকার


বাংলা সাহিত্যের বিরল প্রতিভা সৈয়দ মুজতবা আলী বাঙ্গালীর গ্রন্থ-বিমুখতা নিয়ে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। বই পাঠের সুফল সম্পর্কেও অবহিত করেছেন পাঠকদের। আজ প্রায় এক শতাব্দী পরেও মুজতবা আলীর সেই হতাশার সুরই যেন প্রতিধ্বনিত হয় বর্তমান লেখক-প্রকাশকদের কণ্ঠে। লেখক ও প্রকাশক বলছেন – পাঠক নেই। আর পাঠকরা বলছেন – ভালো লেখক নেই বাংলাদেশে, তার উপর বইয়ের দাম সাধ্যের সীমানার অনেক বাইরে। লেখক-প্রকাশক এবং পাঠকের এই বিপরীতমুখী অবস্থান সত্ত্বেও এই বাংলাদেশেই বই লিখে কোটিপতি হয়েছেন এমন লেখকের উদাহরণও রয়েছে। তাহলে `পাঠক কমে যাচ্ছে’ বলে কেন এই অভিযোগ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বইবাজারে লেখক-প্রকাশক ও পাঠকদের মুখোমুখি হয়ে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন আমাদের প্রতিবেদক সদানন্দ সরকার।

বইয়ের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা নিয়মিত বইয়ের পাঠক তাদের জন্য এটা অনেক বড় সমস্যা। এ অভিযোগ প্রায় সব পাঠকেরই। তারা বলেন – যাদের বইয়ের নেশা, তাদের অন্য বিনোদনে বাঁধা যায় না। ধনীরা নয়, বইয়ের পাঠক হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করতে হবে। জেলা শহরে এমন অনেক পাঠক আছেন যারা হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হক ছাড়াও যে দেশে আরো অনেক লেখক আছেন এটাই জানেন না। ‘আগুনপাখী’ উপন্যাসটি আনন্দবাজার পুরস্কার পাবার পর দেশীয় মিডিয়ায় সংবাদ দেখে অনেকে কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখনী শক্তির পরিচয় জেনেছেন বলে স্বীকার করলেন তারা। তবে সেলিনা হোসেন বা নাসরীন জাহান এর নামও অনেকে শোনেননি, কেউ কেউ তাদেও লেখা পড়েছেন কিন্তু কিছু বোঝেন নি বলেও অভিযোগ পাঠকের। তাদেরকে পাঠকের সাথে পরিচয় না করানো, এটা প্রকাশকদেরই ব্যর্থতা বলে জানালেন পাঠকদের কেউ কেউ।
পাঠকদের সাথে একমত পোষণ করে আমাদের লেখকদের কেউ কেউ বলছেন, অনেক প্রকাশক আছেন যারা নিয়মিত সরকারী বিভিন্ন টেন্ডারে বই বিক্রি করার সুযোগ পান। তাদের প্রকাশিত বই কোন পাঠকের হাতে পৌঁছল কিনা, পাঠক কিনতে পারল কিনা, এ নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। সরকারের কাছে বই বিক্রি করে তারা লাভবান হলেন কিনা এটাই তাদের প্রধান বিবেচ্য। যে কারণে তারা ইচ্ছে করে বইয়ের দাম বেশি রাখেন। একজন নতুন লেখককে এভাবে শুরুতেই মেরে ফেলেন অনেক প্রকাশক।
আবার কেউ কেউ বলেন, অনেক ভালো লেখক সম্পর্কে কিছুই জানেন না পাঠক। মিডিয়ায় যাদের প্রচার আছে পাঠক তাদের সম্পর্কেই আগ্রহী। এ বিষয়ে একমত প্রকাশকরাও। তারা বলেন, পাঠকরা এখন মিডিয়ামুখী। এখন আর তারা পড়তে চায় না। যে পাঠক একসময় বই পড়ে সময় কাটাতেন, এখন সে স্যাটেলাইটে বিভিন্ন বিনোদন দেখে সময় কাটায়। বই পড়ার সময় এখনকার তরুণদের তো নেই-ই। প্রকাশকরা আরো বলেন, যারা বলছেন প্রকাশকরা সরকারের কাছে বই বিক্রি করতে ব্যস্ত, তারা ভুল জানেন, সরকার কয় টাকার বই কেনে? প্রকাশক তো ঘাড়ে করে বই বিক্রি করতে পারে না। তাদের যা করার তা ই করছে। বইতো খুব লাভজনক ব্যবসা নয় যে অন্য পণ্যের মতো মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেয়া যায়।

দেশীয় সাহিত্য সম্পর্কে মতামত জানাতে গিয়ে ‘দেশে কোনো ভালো লেখক নেই’, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরা মুখের উপর এভাবেই কথাটি শুনিয়ে দিলেন। আবার কেউ কেউ বললেন, অনেকে আছেন ভালো লেখেন কিন্তু তাদের উপস্থাপনা ভঙ্গি ভালো লাগে না, সবচেয়ে বড় কথা বইয়ের দাম আমাদের দেশে এত বেড়েছে যে বই কিনে এখন আর আমাদের দ্বারা পড়া সম্ভব হচ্ছে না। লাইব্রেরীতে গিয়েতো গল্প-উপন্যাস পড়ার মজা থাকে না।
গত ১৫ই মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠকক্ষের সম্মুখে অপেক্ষমান জার্নালিজম বিভাগের শেষবর্ষের ফারাহ্ তানাজি ও ব্রতী, ফিলোসফি বিভাগের পলাশ এবং ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশীপ বিভাগের মাস্টার্স শেষবর্ষের ছাত্র শহীদুল ইসলাম অকপটে জানালেন তাদের প্রতিক্রিয়া।


ফারাহ্ তানজি 
পাঠ্য বইয়ের বাইরে আমার খুব একটা পড়া হয়ে ওঠে না। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিম চন্দ্র ছাড়া আর কারো বই পড়া হয়নি। দেশীয় কোনো লেখকের বই ভালো লাগে না।
ব্রতী
ছোটবেলা হুমায়ুন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বই খুব পড়তাম। এখনো কিছু পড়ি সেটা অভ্যাস বসে। পড়ার পর কোন স্বাদ পাই না কিন্তু পড়ি। তবে বেশি পড়া হয় ভারতীয় বই। বাণী বসু, তিলোত্তমা মজুমদার, শীর্ষেন্দুর বই পড়তে খুবই ভালো লাগে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কিছু অনুবাদও ভালো লাগে। তবে আমাদের দেশের লেখকরা যে মানসম্পন্ন লেখা লেখেন না তা কিন্তু নয়, যেমন সৈয়দ শামসুল হক, নাসরীন জাহান খুব মানসম্পন্ন লেখেন কিন্তু তার উপস্থাপনা ভংগিটা আমার জন্য সহজবোধ্য নয়। তাই আমি পড়ি না। দেশীয় আর কারো বই পড়তে ভালোও লাগে না।

দেশীয় আর দু’একজন লেখক সম্পর্কে বলেন না? যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান, শওকত আলী, হুমায়ুন আজাদ কিম্বা হাসান আজিজুল হক? ব্রতীকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি যেন একটু বিরক্ত হলেন তারপর হুমায়ুন আজাদের বই সম্পর্কে বললেন, ওনার কবিতা পড়েছি ভালো লেগেছে কিন্তু নারী আর ঐ যে কী বাজে। হাসান আজিজুল হক খুব ভালো লেখেন শুনেছি, তার আগুনপাখীটা পড়তে গিয়ে কিছু বুঝিনি। তাই আর পড়া হয়নি। আসলে ভালো বই পেলে আমরা যারা পড়তে ভালোবাসি তারা দামের দিকে তাকাই না। যদিও আমাদের দেশের প্রকাশকদের প্রকাশিত বইয়ের গুণগত মান খুব ভালো নয়, তারপরও তারা মূল্যটা অনেক বেশিই রাখেন।

পলাশ
বেশি রাখবে না কেন? ঐ বইমেলার সময়ই তাদের ব্যবসা। একশ’ বই বিক্রী করেই এক বছরের খরচ পুশিয়ে নিতে চান তারা। আমি ভাই, সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অনুবাদ থ্রীলারই পড়ি। এটাই আমার খুব প্রিয়। কখনো সুনীল ও বুদ্ধদেব বসু’র বইও পড়ি, দেশীয় অন্যকোন বই পড়ার সময়ও নেই।


শহীদুল ইসলাম
দেশে কোন ভালো লেখকই নেই। মাঝখানে আনিসুল হকের বই ভালো লেগেছিল, এখন আর লাগে না। মনে হয় তিনি বাচালতা করছেন।
এদিকে শাহাবাগের গণগ্রন্থাগারে পড়তে আসা মিরপুর কাজীপাড়ার বাসিন্দা মোঃ ইউ আকন্দ সেলিম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান থেকে পাস কওে চাকুরী অনুসন্ধানী ছাত্র ইয়াছিন আলী আসাদ জানান, আমরা সুযোগ পেলে সব ধরনের বই পড়ার চেষ্টা করি। ঘরে বসেও পড়ি আবার লাইব্রেরীতে এসেও পড়ি। তবে দেশের মধ্যে হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হক এবং দেশের বাইরে মার্ক টোয়েন, ম্যাক্সিম গোর্কি, শীষেন্দু, বানী বসু, সমরেশ মজুমদার, অরুন্ধতী ইত্যাদি বই বেশি পড়া হয়। সম্প্রতী সাহিত্যে নোবেল পেলেন কানাডিয়ান লেখিকা মুনরোর গল্প পড়লাম, ভালো লেগেছে। সেলিম বললেন, হুমায়ুন স্যারতো আর নেই। এখন আসলে দেশের বাইরের বইটাই বেশি পড়া হয়।
দেশীয় দু’একজন লেখক সম্পর্কে বলেন না? যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান, শওকত আলী, হুমায়ুন আজাদ কিম্বা হাসান আজিজুল হক এদের লেখার মান বা ধরণ আপনার কেমন লাগে? তাদের এ প্রশ্ন করা হলে দু’জনেই যেন খুব অবাক হলেন। মনে হল এ নাম তারা এই প্রথম শুনেছেন। মৃদু হেসে আসাদ বললেন – আসলে হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হক ছাড়াও যে দেশে আর কোন লেখক আছেন, এটাই আমরা অনেকে জানি না। হাসান আজিজুল হকের নামটা অবশ্য ইদানিং শুনছি। তাঁর কী একটা বই যেন আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে। মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে তাই জানি।


মাহাবুবে রাব্বানী
এ সময়ের একজন সচেতন পাঠক, কবি ও রম্য লেখক মাহাবুবে রাব্বানী বলেন, আমি একজন নিয়মিত পাঠক। দেশি-বিদেশী সব ধরনের লেখকের লেখনীর সাথে আমার সৌহার্দ্য রয়েছে। সবার লেখাই কম বেশি আমি পড়ি। আমার মতে, প্রকাশকদের উচিৎ পাঠক বৃদ্ধির চেষ্টা করা। প্রথমেই বইয়ের মূল্য কমাতে হবে। নিম্নবিত্ত এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কম দামে ভালো বই পড়ার সুযোগ দিতে হবে। পাঠকের কাছে বই পৌঁছাতে হবে। জেলায় জেলায় বইমেলা করে পাঠকদের বইয়ের কাছে টেনে আনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাহায্য নিন, তাদের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীতে আপনাদের প্রকাশিত সৃজনশীল বইগুলো তুলে দিন।
রাব্বানী আরো বলেন, এটা সত্যি যে অনেক পাঠক এখন মিডিয়া নির্ভর। আমি ইন্টারনেটে ক্লিক করে ভালো বইয়ের তালিকা সংগ্রহ করি। আন্তর্জাতিক বই বাজারের লেটেস্ট বইটি আমি ঘরে বসেই পড়ে ফেলতে পারছি। কিন্তু এ সামর্থ ক’জনের আছে? কতজন পাঠক স্যাটেলাইট নির্ভর হয়ে পাঠ থেকে সরে গেছেন? যাদের বইয়ের নেশা, তাদের অন্য বিনোদনে বাঁধা যায় না। এটা প্রকাশকদের বুঝতে হবে। ধনীরা নয়, বইয়ের পাঠক হিসেবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করুন। প্রকাশকদের প্রতি এটাই আমার অনুরোধ। আর আমাদের লেখকদের অনুরোধ করবো, দয়া করে আপনারা বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণ বন্ধ করে, নোবেল পাওয়ার লোভটা সংবরণ করে, আমাদের লোকজ সাহিত্যের অনুসরণ করুণ। ঠকবেন না। পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের প্রতিটি কবিতায় আপনার একটি উপন্যাস লুকিয়ে আছে।


লেখক-প্রকাশক ও পাঠকদের এ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়ে এ সময়ের কয়েকজন লেখকের মুখোমুখি হলে তারা বলেন-
যতীন সরকার
লোক গবেষক, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ যতীন সরকার বলেন, পাঠক নেই কথাটি ঠিক নয়। তবে পাঠক কমে যাচ্ছে কথাটি ঠিক। কেননা এখনকার তরুণদের মধ্যে পাঠস্পৃহা অনেক কম। আমাকে যেমন আমার ঠাকুরদা বাংলা অক্ষরগুলোর সাথে পরিচয় করাতে করাতে বইয়ের রাজ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন এবং আজও আমি বইয়ের রাজ্য থেকে বের হতে পারিনি এমনটা এখন আর ঘটে না। কারণ এখনকার ছেলে-মেয়েরা ঠাকুরদা শব্দের সাথেই পরিচিত কিনা আমার সন্দেহ আছে। এখনকার তরুণরা স্যাটেলাইট নির্ভর। পড়ার চেয়ে দেখতে বেশি পছন্দ করেন তারা। কিন্তু বই পড়ার স্বাদ, যে একবার পেয়েছে সেই বুঝবে। তাই আমি বলবো পাঠক বৃদ্ধিতে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। মিডিয়াই পারে তরুণদের এই স্বাদ ফিরিয়ে দিতে। অনেক ভালো প্রকাশনী রয়েছে, যারা ভালো বই করেন, কিন্তু তাদের প্রচারণাটা একটু কম। মিডিয়া কভারেজ পেলে তাদের বই সম্পর্কে পাঠক জানতে পারবে। বইয়ের ব্যবসা এতোটা লাভজনক নয় যে, প্রকাশকরা মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। এছাড়া জেলায় জেলায় এখন সরকারীভাবে বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে, সঠিকভাবে মিডিয়া কভারেজ পেলে এই মেলাগুলোতেই পাঠক বাড়বে।


আতা সরকার
এ সময়ের একজন সামাজিক দায়বদ্ধ লেখক আতা সরকার বলেন, এ সময়ের পাঠক বিশেষ করে তরুণরা যাদের বই পড়েন তাদের বেশিরভাগই মূলধারার লেখক না। আমাদের সময় যারা জনপ্রিয় লেখক ছিলেন – নিমাই ভট্টাচার্য, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ মূখার্জী তারা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তারা মূলধারার লেখক ছিলেন না সেইভাবে। মূলধারার লেখকরা প্রচারের বৈগুন্যে সবসময় একটু পিছনে থাকেন। এটাই স্বাভাবিক। একই সময় আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয় ছিল রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’। সেবার অনুবাদ ‘মাসুদ রানা’ এখনো জনপ্রিয়। এ ধরণের সস্তা জনপ্রিয়তা সবসময়ই থাকে। মূলধারার লেখক সম্পর্কে পাঠকের অবহিতি প্রচারগত কারণে কমই থাকে। কিন্তু সাহিত্যে টিকে থাকে মূলধারার লেখকরাই। এদিক থেকে আমার মনে হয় মূলধারার লেখকদের বই যারা প্রকাশ করেন, সেই প্রকাশকরাই মূলত পাঠকের সাথে লেখকের পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস না। সবচাইতে প্রধান বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রকাশকরা পাঠকদের কাছে বই পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে, বই বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রক্রিয়াগুলো ব্যবহার করেন না। আমি সাম্প্রতিক কালে প্রকাশকদের যে প্রবণতা লক্ষ করেছি তা হচ্ছে – তারা বই প্রকাশ করে শুধু মাত্র সরকারী বড় সাপ্লাই ধরার জন্য। যে কারণে তারা পাঠকের নাগালের বাইরে বইয়ের দাম রাখেন, এই আশায় যে এতে সরকারীভাবে বিক্রি করতে গেলে তারা ভালো দাম পাবেন, এখানে হয়তো আরো কিছু লুকানো ব্যাপার রয়েছে। যে কারণে প্রকাশকদের এ্যম্বিশনই হচ্ছে সরকারীভাবে বই বিক্রী করা। এতে করে বই নিয়ে সরকারের যে একটা স্বদিচ্ছা, সেটা মাঠে মারা যাচ্ছে।


নাসরীন জাহান
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক নাসরিন জাহান বলেন, পাঠক লেখক ও প্রকাশক এ তিনের সমন্বয় প্রয়োজন। পাঠক কী চায়, সেটা যেমন লেখককে বুঝতে হয়, ঠিক তেমনি প্রকাশকদেরও বুঝতে হবে। পাঠকের কাছে বইটি পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব তো প্রকাশকই নিচ্ছেন। এখন এ কাজটা প্রকাশক কিভাবে করবেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আমরা একজন প্রকাশকের উপর বিশ্বাস করে, ভরসা করে আমাদের লেখা দেই। সেটা কত কপি বই বজারে এল, কত কপি বিক্রি হল কখনো তা জানতে যাই না, প্রকাশক যা বলেন বিশ্বাস করতে হয়। এখানে প্রকাশক আর লেখকের মাঝে একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক থাকে বলেই বিশ্বাসটা তৈরি হয়। তেমনি পাঠকের বিশ্বাস তার লেখকের প্রতি প্রকৃতিগত। এ বিশ্বাসটা প্রকাশককেও অর্জন করতে হবে। তবে আমার মতে, প্রকাশককে আধুনিক বিক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করতেই হবে। বর্তমান বাজার প্রচারের বাজার। যার প্রচার যত বেশি সেই তত লাভবান হচ্ছেন। এটা তো প্রমাণিত। তাদের সংগঠন রয়েছে, এ সংগঠন থেকে মিডিয়াওয়ালাদের কাছে তারা বিজ্ঞাপনের ছাড় চেয়ে আবেদন করতে পারেন। অযথা পাঠককে দোষারোপ করে কী লাভ? কলেজ স্টুডেন্ট আর বেকারদের জন্য বইয়ের দাম তো আসলেই বাড়তি। সৃজনশীল বইয়ের পাঠক তো এরাই। চাকুরে বা ব্যবসায়ীরা কি বই পড়ার সময় পান? তবে আশার কথা এই যে, অন্যপ্রকাশ, প্রথমা, পাঠক সমাবেশ, চিটাগাং এর বাতীঘর এরা আধুনিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যা হয়ত আগামিতে অন্যদের পথপ্রদর্শক হবে।


রেজাউদ্দিন স্টালিন
এ সময়ের প্রতিশ্র“তিশীল কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, আমি বলবো বর্তমান সময়ের পাঠকরা বই পড়তে চায়। বই পড়ার সদিচ্ছা তাদের আছে। কিন্তু বর্তমানে বইয়ের যে হারে মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে তাতে পাঠকের বই কেনার আগ্রহ নষ্ট হচ্ছে। কারণ আমাদের পাঠক কারা? স্বাভাবিক ভাবেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীরা। চাকুরীজীবী বা আয়ক্ষম লোকের মধ্যে পাঠক কম। কারণ যারা আয় রোজগার করেন, তাদের জীবীকার জন্য ছুটতে হয়, বই পড়ার মত সময় তাদের হাতে খুব কম। তাছাড়া আমাদের দেশের পাঠকদের প্রবণতাই হচ্ছে ছাত্র জীবন শেষ, মানে তাদের আর পড়ার প্রয়োজন নেই। যে কারণে ছাত্র-ছাত্রীরাই আমাদের নিয়মিত পাঠক। কিন্তু বইয়ের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এদের অনেকেই আর বই কেনার সামর্থ ধরে রাখতে পারেননি। যে কারণে পাঠক বাড়ছে না। আর একটা সমস্যা হচ্ছে বইয়ের সহজ প্রাপ্তি। যে বইটি খুঁজছি সেটি হাতের কাছে পাচ্ছি না। এটাও পাঠক হারাবার কারণ। আর এ জন্য দায়ী আমাদের দেশের প্রকাশকরা। তারা বাণিজ্যিক বইয়ের প্রকাশনায় ব্যস্ত হয়ে ভালো বইয়ের প্রতি অবিচার করেন, বিভিন্নভাবে। তবে তারা যে ভালো বই করেন না তা না। তবে সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনীর প্রচারণাটা একটু কম। এ জন্য মিডিয়া কভারেজ নির্ভর হলে চলবে না। জেলায় জেলায় বইমেলা করতে হবে, সে মেলায় বইটা পৌঁছাতে হবে। এতে করে পাঠক বাড়বে। যেটা ২১ শের বইমেলায় দেখা যায়।
প্রতিবছর বইমেলা এলেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন লেখক ও প্রকাশক। ব্যস্ত হয়ে পরে বাংলা বাজারের প্রকাশনা পাড়ার প্রিন্টার, বাইন্ডার ও কাগজওয়ালারা। সাধারণত ডিসেম্বরের জাতীয় গ্রন্থমেলা এবং ২১ শে বইমেলাকে ঘিরেই তাদের এই ব্যস্ততা শুরু হয়। চলতি বছর এ দৃশ্যে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে মনে হলো। যদিও এ বছর ডিসেম্বরের ১২ থেকে ২২ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন ও বইমেলা করতে যাচ্ছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইতোমধ্যেই চলছে এই উদ্যোগ আযোজন। ডিসেম্বরের জাতীয় গ্রন্তমেলাকে ঘীরে গত সেপ্টেম্বর থেকেই প্রেসগুলোতে ব্যস্ততা কিছুটা শুরু হয়ে গেছে বলে জানালেন কারুকর প্রিন্টার্স ও শিল্পশ্রি প্রকাশনীর সত্বাধিকারী সালাম খোকন। তিনি বলেন, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের অনুপস্থিতি এবার প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাই ছাপখানায় এবার চাপ কম।
বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেল বইয়ের প্রকাশনা, বইমেলায় স্টল বরাদ্দ – এ সব নিয়ে প্রকাশকদের ব্যস্ততাও যেন এবার অনেকটা কম। তারপরও ব্যস্ততা আছে, ডিসেম্বরের জাতীয় গ্রন্থমেলা এবং একুশের বইমেলার শেষদিনে শেষ হয় প্রকাশকদের এই ব্যস্ততা। চলতি বছর ২১ শে বইমেলা ছিল অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় অনেক ব্যবসা সফল। প্রায় সব ধরণের বই-ই বিক্রি হয়েছে কম বেশি। তবে হঠাৎ করে কাগজের মূল্য বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে বইয়ের দামও বেড়েছে, যে কারণে বইমেলা থেকেই অনেক পাঠক আপত্তি তুলে আসছেন যে, ‘বইয়ের দাম অনেক বেশি ধার্য হয়েছে’। জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা বার বার বলেছেন- ‘এতে অনেক পাঠক হারাতে হবে’। একুশের বইমেলায় প্রতি ১৬ পৃষ্ঠার জন্য (১ ফর্মা) মূল্য নির্ধারণ হয়েছে ২৫ টাকা। অর্থাৎ ৬ ফর্মাা বা ৯৬ পৃষ্ঠার একটি বই বিক্রয় মূল্য ধার্য হয়েছে ১৫০ টাকা।
তারপরও প্রকাশকরা বলছেন, বইয়ের দাম মোটেও বেশি নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজসহ প্রকাশনা সংক্রান্ত দ্রব্যের দাম যে হারে বেড়েছে, তার সাথে সংগতি রেখেই বইয়ের দাম বেড়েছে এবং যতটুকু বেড়েছে তা পাঠকের সাধ্যের বাইরে নয়। এ নিয়ে প্রকাশকদের মুখোমুখি হলে তারা বলেন


মহিউদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি এবং ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর সত্ত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমদ জানালেন, বইয়ের মূল্যবৃদ্ধি সঙ্গত কারণেই হয়েছে। তবে স্কুল কলেজের বইয়ের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য আছে। এর কারণ আমাদের সমাজের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, স্কুলগুলোর ব্যবসায়িক মনেবৃত্তি, বাজার ব্যবস্থা এবং বিষয়টি অনুধাবন ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবার ব্যাপারে অভিভাবকদের নিষ্ক্রীয়তা।
তিনি আরও জানান, আমাদের সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির বর্তমানে প্রায় ৫০ জন সদস্য  রয়েছে, যারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বইবাজার থেকে দুর্নীতি দূর করতে। পাইরেসি বন্ধ করতে। যারা বলেন প্রকাশকরা সরকারী সাপ্লাই ধরতে ব্যস্ত, পাঠকের কাছে বই পৌঁছাতে চায় না। তারা সঠিক বলছেন না। সরকার কত টাকার বই কেনে? পাঠকের কাছে প্রকাশক কীভাবে পৌঁছাবে? বইয়ের লাভ দিয়েতো বিজ্ঞাপন দেয়া সম্ভব নয়। প্রকাশকরা কি তবে ঘাড়ে করে সারা দেশে বই ফেরী করে বেড়াবে? প্রকাশকদের পক্ষে যেটা সম্ভব হয়, সেটাই তারা করে। পাঠক সৃষ্টির মাধ্যমে চাহিদা সৃষ্টি, কোন প্রকাশক বা লেখকের একার ব্যাপার নয়। পুরো সমাজটাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি এ ব্যাপারে জাতীয় গ্রন্থনীতির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।


আহমেদ মাহমুদুল হক
এ প্রসঙ্গে মাওলা ব্রাদার্সের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ মাহমুদুল হক বলেন, বইয়ের দাম বেশি, পাঠকের এ অভিযোগ কিছুটা সত্যি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে যদি দেখি, তাদের তুলনায় আমাদের বইয়ের মান কোন অংশে খারাপ নয় এবং দামও খুব বেশি নয়। যেখানে সারা বিশ্বে কাগজের দাম বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে প্রিন্টিং ম্যাটারিয়ালস্- কালি, রং, প্লেট তেরি সরঞ্জাম ইত্যাদির দাম। সেখানেতো আমাদের কিছু করার নেই। কাগজের দাম কমলে বইয়ের দামও কমবে। আমরা এখন ফর্মা প্রতি (১৬ পাতা) বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করেছি ২৫ টাকা।


শাহিদুল ইসলাম বিজু
পাঠক সমাবেশের সত্ত্বাধিকারী শাহিদুল ইসলাম বিজু জানালেন, আমরা যারা সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশক তারাতো মিডিয়ার হাতে জিম্মী হয়ে আছি। একজন পাঠক সকালে ঘুম থেকে উঠে যে বইটির সংবাদ জানতে পারে বা দেখতে পায়, সে বইটির প্রতি তার একটা দূর্বলতা তৈরি হয়। আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো লেখক আছেন যাদের নামও পাঠক জানেন না। মিডিয়া যাকে ওঠায়, পাঠক তার কথাই জানতে পারে। মিডিয়ার কারণেই হাতে গোণা ক’জন লেখক কোটিপতি হচ্ছেন। অথচ একজন লেখক যিনি বহু কষ্টে টাকা জোগার করে নিজের টাকায় একটা বই প্রকাশ করেন, তার কাছে তো আর মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেয়ার মত টাকা থাকে না। বইটি বাজারে আনতেই যে তিনি নিঃস্ব হয়েছেন। এমনাবস্থায় যদি তার বইটি ভালো হয়, তাহলে মিডিয়ারই উচিৎ তাকে কভারেজ দেওয়া। উন্নত বিশ্বে প্রকাশকরা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আর আমরা মিডিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। কারণ, আমাদের প্রকাশকদের মধ্যে কোন একতা নেই, তাদের বেশিরভাগই ঠিকাদার শ্রেণীর লোক। হাতে গোনা কয়েকজন আছেন যারা নেশা থেকে প্রকাশক হয়ে এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন। পাঠক নেই বা পাঠক কমে যাচ্ছে কথাটা ঠিক নয়, বরং আমরাই পাঠকদের দূরে ঠেলে দিচ্ছি, মিডিয়ার মাধ্যমে হাল্কা মানের লেখকদের প্রাধান্য দিয়ে।


ওসমান গণি
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং আগামী প্রকাশনীর পরিচালক ওসমান গণি বলেন, শুধু যে বইমেলাকে কেন্দ্র করেই বই প্রকাশিত হয় তা কিন্তু সঠিক নয়। সারাবছর ধরেই কম বেশি বইয়ের প্রকাশনা চলছে। তবে একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ এ সময় বইয়ের রিটার্নটা ভালো পাওয়া যায়, যা জাতীয় গ্রন্থমেলাতেও পাওয়া যায় না। আমার মতে, জেলা শহরের পাড়ায় পাড়ায় বছরের সবসময়ই বইমেলার আয়োজন হলে পাঠক বাড়বে। পাঠ-অভ্যাস তৈরি হবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে গড়ে প্রতিবছর প্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধসহ অনুবাদ বা অন্যান্য সাহিত্য বইয়ের সংখ্যা প্রায় হাজার খানেক। বইমেলা ছাড়া এ সব বইয়ের বিক্রি নেই বলতে গেলে।

পরিশেষে বলতে হয়, এখানে একটি জায়গায় পাঠক, লেখক ও প্রকাশকরা ঐক্যমত্যে পৌঁছালেন। তারা সবাই একযোগে মিডিয়ায় বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ৫০ ভাগ ছাড় দেয়ার দাবী জানালেন। পাঠকরা তাদের সাক্ষাৎকার অংশে যুক্তি দিয়েছেন যে, হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হক ছাড়াও যে দেশে আর কোন লেখক আছেন এটাই অনেকে জানতেন না। ‘আগুনপাখী’ উপন্যাসটি আনন্দবাজার পুরস্কার পাবার পর দেশীয় মিডিয়ায় সংবাদ দেখে অনেকে হাসান আজিজুল হকের লেখনী শক্তির পরিচয় জেনেছেন। তাদের মতে, এ জন্য মিডিয়ার উচিৎ সব লেখকদের কভারেজ দেয়া এবং সব লেখকেরই বইয়ের জন্য ৫০ ভাগ ছাড় দেয়া। অন্যদিকে একটু ঘুরিয়ে একইকথা বলেছেন লেখকরাও। তাদের দাবী, পাঠকবৃদ্ধিতে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। অনেক ভালো প্রকাশনী রয়েছে যারা ভালো বই করেন, কিন্তু তাদের প্রচারণাটা একটু কম। মিডিয়া কভারেজ পেলে তাদের বই সম্পর্কে পাঠক জানতে পারবে। বইয়ের ব্যবসা এতোটা লাভজনক নয় যে, প্রকাশকরা মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। আর প্রকাশকরা তো বরাবরই বইয়ের বিজ্ঞাপনের জন্য শুধু বইমেলার সময় নয়, সব সময় ৫০ ভাগ ছাড়ের দাবী জানিয়ে আসছেন। তাদের এই দাবীর মুখেই মূলত ২১ শে বইমেলার সময় জাতীয় দৈনিকগুলোতে বইয়ের বিজ্ঞাপনে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়। শুধু বইমেলায় নয় সারাবছরই বইয়ের বিজ্ঞাপনে ৫০ ভাগ ছাড় দেয়া হোক এ দাবী আমাদেরও। যদিও তাদের এই দাবী ওঠার আগেই ‘সাহিত্য বাজার’ বইয়ের বিজ্ঞাপনে ৫০ ভাগ ছাড়ের প্রস্তাব রেখে প্রকাশকদের দ্বারে বিজ্ঞাপন চেয়ে ঘুরেছে। কিন্তু কোন প্রকাশকের সহানুভূতি অর্জন করতে পারেনি। আজ পর্যন্ত পায়নি কোন প্রকাশনী বা বইয়ের বিজ্ঞাপন।


Wednesday, March 27, 2013

বই প্রকাশের তিতা অভিজ্ঞতা

বই প্রকাশের তিতা অভিজ্ঞতা

-ইকবাল খন্দকার

আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। ঘাড়ে ভূত চাপার মতো হঠাত্ করেই আমার সাধ চাপল বই বের করার। শুরু করলাম তদবির। আমাদের পাশের গ্রামের এক লোকের বেশ বড় একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকায়। এই লোকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে একদিন তাকে ফোন করলাম। বললাম বই প্রকাশের ইচ্ছের কথা। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো আমি কী করি। যেই না বললাম আমি ইন্টারে পড়ি, সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে গেল। আমি ভাবলাম লাইনে কোনো সমস্যা তাই আবার ফোন করলাম। একটু আগে যে কণ্ঠটিকে বেশ গুরুগম্ভীর এবং ভদ্রসদ্র মনে হয়েছিল, সেই কণ্ঠটিই খেঁকিয়ে উঠল এবার—ফোন কেটে দিয়েছি আবার ফোন কিসের! আমি মৃদু ভয় পেয়ে গিয়ে বললাম—না, মানে ওই যে বই প্রকাশের কথা বলেছিলাম। এবার মনে হয় লোকটার খেঁকানো ভিন্ন মাত্রা পেল—এই ছেলে তুমি কি করে ভাবলে তোমার মতো ইন্টারের একটা ছেলের বই আমি প্রকাশ করব? তুমি জান আমি কত বড় মাপের প্রকাশক? জান কত বড় বড় লেখক আমার পেছনে ঘুরঘুর করে বই প্রকাশের জন্য? এবার মনে হয় আমি একটু সাহস পেলাম। বললাম—যেহেতু আপনার পেছনে লেখকরা ঘুরঘুর করে, তার মানে আপনার গাড়ি নেই, তাই তো? গাড়ি থাকলে তো ঘুরঘুর করতে পারত না। পেছনে দৌড়াতে হতো। এবার বিকট আওয়াজ করে ফোন রেখে দেয়া হলো ওপাশ থেকে। ফোন রেখে দেয়ার এই আওয়াজে আমার কানের পর্দা বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হলো। আঘাতপ্রাপ্ত হলো আমার মনও। একবার তো মনেই হলো আমার মনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। আমি মনের এই টুকরোগুলোকে একত্রিত করে আবার নতুন আশায় বুক বাঁধলাম। তবে বুক এত শক্ত করে বাঁধলাম যে, মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। আর দম বন্ধ হওয়ার প্রথম প্রমাণ পেলাম বাবার কাছে গিয়ে। বাবার কাছে গিয়েছিলাম মূলত টাকার জন্য। কারণ, এর মধ্যে আমি জেনে গিয়েছিলাম প্রথম বই প্রকাশ করতে টাকা লাগবেই। টাকার অ্যামাউন্টটাও জেনে নিয়েছিলাম একজনের কাছ থেকে। তারপর যেই না টাকাটা চাইলাম, বাবা হাত বাড়ালেন ডান দিকে। আমি ভাবলাম তিনি বুঝি আলমারি খোলার জন্য চাবি নিচ্ছেন। কিন্তু পাশেই যে একটা বাঁশের গোড়া ছিল, তা আর খেয়াল করিনি। খেয়াল করলাম যখন তিনি এটা হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে আমার সামনে এসে পড়লেন। আমি বাংলা ছবির নায়িকাদের মতো বাঁচাও বলে একটা চিত্কার দিয়ে শুরু করলাম দৌড়। বাবাও আমার পেছনে পেছনে দৌড়াতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন—পড়ালেখার নাম-গন্ধ নেই, উনি বই বের করবেন। বের করাচ্ছি বই। আমি দৌড়াচ্ছি, বাবাও দৌড়াচ্ছেন। দৌড়াতে দৌড়াতে আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল, বাবা শেষ বয়সে এত অ্যানার্জি কোত্থেকে পেলেন, কীভাবে পেলেন। আমি খালি হাতে দৌড়াচ্ছি, আর বাবা দৌড়াচ্ছেন বাঁশের গোড়া নিয়ে। বাঁশের গোড়াটার ওজন কম করে হলেও পাঁচ কেজি হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, এরপর বাবার সঙ্গে যখন সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে, তখন আমি তাকে এই অ্যানার্জির গোপন রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। সম্ভব হলে তার কথাগুলো রেকর্ড করে রাখব। ভবিষ্যতে যদি কেউ কখনও এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপন করতে চায়, আমি মডেল হিসেবে বাবার নাম প্রস্তাব করব। যাক, দৌড়াতে দৌড়াতে যখন আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন কী মনে করে যেন বাবা দৌড়ানি বন্ধ করলেন। তিনি চলে এলেন বাড়িতে, আমি মাঠে বসে হাঁপাতে লাগলাম। রাতে বাড়ি ফিরে বাবার চেহারা দেখে আমি অবাক হলাম। শতভাগ পজিটিভ চেহারা। এক সময় তিনি ডেকে নিয়ে আমার হাতে পনের হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেন। আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তখনও আমি চোখ বড় বড় করে খেয়াল করছিলাম, তিনি বাঁশের গোড়ার জন্য হাত বাড়ান কিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন তা না করে টাকা দিলেন তখন একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমার অনুপস্থিতিতে মা তাকে সোজা করে ফেলেছেন। আমি এই টাকা নিয়ে পরদিনই মাঠে নেমে পড়লাম। আরেক প্রকাশক খোঁজ করে টাকার বিনিময়ে পাঁচশ কপি বই প্রকাশ করেই ফেললাম। বই প্রকাশ হওয়ার দিন কয়েক আগে থেকেই যখন সবার কাছে বলছিলাম আমার বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে, তখন আমার প্রতি সবার সে কী আশ্বাস! আমার বই একেকজন কমপক্ষে দশ কপি করে কিনবে। কেউ আবার এমনও বলল—বই পাঁচশ না, বরং পাঁচ হাজার কপি ছাপাতে। নইলে নাকি সবাই বই পাবে না। একেকজন দশ কপি করে কিনলে যা হয় আর কি। যথাসময়ে বই প্রকাশিত হলো। আমি নিজ উদ্যোগে এলাকার সব লাইব্রেরিতে বই দিলাম। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম কবে এসব লাইব্রেরির মালিকরা আমাকে খবর পাঠাবে টাকা নেয়ার জন্য। আর বলতে আরও বই দিতে। মাস ছয়েক অপেক্ষার পরও যখন কোনো খবর টবর হলো না তখন একদিন গেলাম লাইব্রেরির দিকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক হিসেবে তারা আমাকে এমন জোরে জড়িয়ে ধরবে যে, আমি তাদের বুক থেকে সরতেই পারলাম না। তারপর দোকানে যত রকমের খাবার পাওয়া যায় সবই এনে খাওয়াবে। একটা লাইব্রেরির দরজায় পা রাখতেই আমার খানিকটা খটকা লেগে গেল। কারণ মালিকের মুখ হেভি কালো। প্রথম ভাবলাম অনেকদিন হয়তো তিনি রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করেন না তাই কালো দেখাচ্ছে। একটু পরেই বুঝে গেলাম পুরো ঘটনা। এই কয় মাসে নাকি তার দোকান থেকে তিন কপি বই বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য লাইব্রেরির খবরও একই রকম। এই একই রকম খবরের মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু খবরও পাওয়া গেল। তা হলো—বেশ কটি লাইব্রেরিতে এক কপিও বিক্রি হয়নি। এর মধ্যে এক বিক্রেতা আমাকে বলল—বই এখানে সেখানে না দিয়ে একুশে বইমেলায় ছাড়ুন। একমাস পরেই ছিল বইমেলা। প্রকাশককে বলে কয়ে মেলায় তুললাম বই। প্রকাশক বলল কিছু বিজ্ঞাপন দিন, নইলে বই চলবে না। কিছু পোস্টারিংও করতে পারেন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম বিজ্ঞাপনের খরচের তুলনায় পোস্টারিংয়ের খরচ অনেক কম। একদিন রাতে কয়েক বন্ধুকে নিয়ে বের হলাম পোস্টার লাগাতে। এক দেয়ালে পোস্টার লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে চারজন লোক এসে ধরে ফেলল আমাদের। পরে জানতে পারলাম ‘পোস্টার লাগানো নিষেধ’ লেখা দেয়ালে নাকি আমরা পোস্টার লাগিয়েছি। অন্ধকারের জন্য আমরা লেখাটা দেখতে পাইনি। লোকগুলো আমাদের ধরে নিয়ে গেল তাদের মনিবের কাছে। হাবভাব দেখে বুঝলাম, আমাদের পুলিশে দেয়া হবে। মনিব থানায় ফোন করার আগে মুখ ভেংচে আমাদের জিজ্ঞেস করল—এই বেটারা, দেয়ালে ‘পোস্টার লাগানো নিষেধ’ লেখা আছে দেখতে পাসনি? তাহলে কোন সাহসে পোস্টার লাগিয়েছিস! হঠাত্ একটা বুদ্ধি এলো আমার মাথায়। বললাম—চাচা, আমরা লেখাটা দেখলেও পড়তে পারিনি। আমরা সবাই অশিক্ষিত তো! ওই প্রকাশনার কর্মচারী।